মুক্তার হাসান,টাঙ্গাইল প্রতিনিধি:০৩ সেস্টেম্বর-২০২২,শনিবার।
টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের প্রশাসক একুশে পদকপ্রাপ্ত সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান খান ফারুক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ের সর্ব কনিষ্ঠ সংসদ সদস্য। বর্ষীয়ান এই রাজনীতিবিদের মুজিব কোটই একমাত্র পোশাক। জাতির জনকের ঘনিষ্ঠ এ সহচরের বাড়ি মির্জাপুর উপজেলার উয়ার্শী ইউনিয়নের কহেলা গ্রামে। ১৯৪৪ সালের ১২ অক্টোবর সমভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে তার জন্ম। বাবা প্রয়াত আব্দুল হালিম খান ও মা প্রয়াত ইয়াকুতুন্নেছা খানমের আট সন্তানের মধ্যে তিনি তৃতীয়। বর্ণাঢ্য এই রাজনীতিবিদের জীবন নতুন প্রজন্মের কাছে রয়েছে অজানা। রাজনীতির পাশাপাশি করেছেন সাংবাদিকতা। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় টাঙ্গাইল জেলা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। এখন তার সম্পাদনায় টাঙ্গাইল থেকে প্রকাশিত হচ্ছে ‘আজকের দেশবাসী’ নামে একটি দৈনিক পত্রিকা। তিনি এক ছেলে ও এক মেয়ের জনক। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ফজলুর রহমান খান ফারুকের রাজনীতিতে হাতেখড়ি ১৯৬০ সালে। সে সময় তিনি ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞান বিভাগে মাস্টার্স পাস করেন। তিনি ১৯৬২ সালে টাঙ্গাইল মহকুমা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করায় কারাবরণ করেন। সেই সঙ্গে টাঙ্গাইল করটিয়া সরকারি সা’দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে বহিষ্কার হন। ১৯৬৫ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে কারাবরণ করেন। ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি, ১৯৬৮ সালে ১১ দফা আন্দোলন কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিটির সদস্য, ১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ এবং কারাবরণ করেন। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে টাঙ্গাইল জেলার ১০৭টি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটি করেন এবং টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। একই বছর টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হন। ১৯৭১ এর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর নিজ নির্বাচনী এলাকা মির্জাপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার লক্ষ্যে ছাত্র-যুব সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং ঢাকার বাইরে ৩ এপ্রিল প্রথম প্রতিরোধযুদ্ধে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। ’৭১-এর ১৮ এপ্রিল ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ঢালু দিয়ে ভারতে যান এবং ১১ নম্বর সেক্টরের তুরা মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং সেন্টারে পলিটিক্যাল মটিভেটরের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর মুজিব বাহিনী গঠন করা হলে টাঙ্গাইল জেলা মুজিব বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। একই সালে দেশ ত্যাগের পর জুলাই-আগস্ট মাসে তদানীন্তন পাক সরকার অনুপস্থিতিতে তাকে ১৪ বছর সশ্রম কারাদন্ড দেয় এবং প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য পদ বাতিল করে। ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশ গঠনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ৭২’ সালে স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য গঠিত গণ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নে সবচেয়ে কম বয়সে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। ৭৪’ সালে দেশের উন্নয়নের জন্য জাতীয় ঐক্যের রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠিত হলে টাঙ্গাইল জেলা বাকশালের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ৭৫’ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর খুনিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখেন। ১৯৮৪ সালে কাউন্সিলের মাধ্যমে প্রথম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে ২০১৫ সালের ১৭ অক্টোবর পর্যন্ত কাউন্সিলের মাধ্যমে একই পদে দায়িত্ব পালন করেন। ৭৫ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়াবিরোধী আন্দোলনে নেতাকর্মীদের সংগঠিত করেন। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার সারাদেশে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন শুরু করলে তিনি প্রতিবাদ এবং নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ ও নির্যাতিতদের পাশে থেকে বিভিন্ন সাহায্য সহযোগিতা করেন। ১/১১ সময় শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হলে তার মুক্তির দাবিতে জনমত গঠন করেন। ২০১১ সালে জাতিসংঘের ৬৬তম সাধারণ পরিষদের সভায় প্রধানমন্ত্রীর দলভুক্ত হয়ে অধিবেশনে যোগ দেন। ২০১১ সালে ২০ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল জেলা পরিষদের প্রশাসক নির্বাচিত হন। ২০১৭ সালে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে চলতি সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৫ সালের ১৮ অক্টোবর কাউন্সিলের মাধ্যমে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। বর্তমানে তিনি জেলা পরিষদের প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি রাজনীতির পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডেও নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। ৬২ সাল থেকে ৬৫ সাল পর্যন্ত দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার টাঙ্গাইল প্রতিনিধি ও টাঙ্গাইল মহকুমা প্রেসক্লাব এবং টাঙ্গাইল মহকুমা মফস্বল সংবাদদাতা সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭২ সালে রেডক্রসের আজীবন সদস্য পদ পান। ’৭২ সাল থেকে ’৭৫ সাল পর্যন্ত টাঙ্গাইল জেলা রেডক্রসের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালের ১ এপ্রিল মির্জাপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং দীর্ঘদিন সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৭৪ সাল থেকে ৭৮ সাল পর্যন্ত মির্জাপুর কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতির লি: (বিআরডিবি)-এর সভাপতি থাকার সময়ে মির্জাপুরের বিভিন্ন গ্রামে ১৭৭টি গভীর নলকূপ স্থাপন করেন। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জেলা ক্রীড়া সংস্থার সদস্য ও ক্রিকেট উপ-পরিষদের সভাপতি এবং জেলা শিক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া টাঙ্গাইলের শতবর্ষ প্রাচীন করোনেশন ড্রামাটিক ক্লাব ও টাঙ্গাইল ক্লাবের আজীবন সদস্য, টাঙ্গাইল সাধারণ গ্রন্থাগারের আজীবন সদস্য, জেলা শিল্পকলা একাডেমির আজীবন সদস্য ও টাঙ্গাইল হার্ট ফাউন্ডেশনের আজীবন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি মির্জাপুরের গোড়াই, দেওহাটা, কুড়িপাড়া, রাজাবাড়ী উচ্চ বিদ্যালয়, মির্জাপুর ফুলকুঁড়ি শিশু নিকেতন ও মির্জাপুরের ২৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। দেশের রাজনীতিতে ও সামাজিক কর্মকান্ডে নিজেকে কিভাবে আরো বেশি নিয়োজিত রাখা যায় সেজন্য ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ আফ্রিকা, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও জাপান ভ্রমণ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। তিনি ‘কেন সংগ্রাম করি’ নামে একটি বইও লিখেছেন। ফজলুর রহমান খান ফারুক তার মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে টাঙ্গাইল জেলাকে মডেল জেলা হিসেবে রূপান্তর করার জন্য দিন রাত পরিশ্রম করে প্রয়োজনীয় কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া তিনি জাতীয় রাজনীতিতে তার মেধা কাজে লাগাচ্ছেন। পাশাপাশি তিনি তার নিজ উপজেলা মির্জাপুরকে আধুনিক মির্জাপুর হিসেবে গড়ে তোলার কাজ করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী ফজলুর রহমান ফারুকের হাতের ছোঁয়ায় মির্জাপুরসহ টাঙ্গাইল জেলাকে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে রূপান্তর করার জন্য প্রয়োজনীয় উন্নয়ন কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন একাগ্রচিত্তে। মসজিদ-মন্দির, ব্রিজ, কালভার্ট, রাস্তাঘাট, ছিন্নমূল অসহায় মানুষের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। বর্ষীয়ান এ নেতার গঠনমূলক চিন্তা-ভাবনার ভেতর দিয়ে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে চলছে মির্জাপুরসহ টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষণা অনুযায়ী ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিণত হবে- সে লক্ষ্যেই তিনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ফজলুর রহমান খান ফারুক বলেন, প্রাকৃতিক সম্পদের এই অপার সম্ভাবনাময় দেশটাকে একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ার যে স্বপ্ন ছিল বঙ্গবন্ধুর, সে আলোকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে খুবই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ আজ বিশ্ব দরবারেও অনেক গুরুত্ব বহন করছে। তাছাড়া স্বপ্নের পদ্মা সেতু নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দেশে অর্থনৈতিক অবস্থার এক আমূল পরিবর্তন হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। নিজে রাজনীতি থেকে কখনো দূরে যেতে পারেননি। সেজন্য পরিবারের সদস্যদের রাজনীতির হাতেখড়ি দিয়েছেন। বাবার সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস সামনে রেখে তার একমাত্র ছেলে খান আহমেদ শুভ বাবার পাশে থেকে দলের জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কাজ করছেন। খান আহমেদ শুভ বর্তমানে টাঙ্গাইল-৭ (মির্জাপুর) সংসদ সংসদ সদস্য। টাংগাইল জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য, টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ও এফবিসিসিআই-এর পরিচালক। স্বাধীনতার পর থেকেই ফজলুর রহমানের একমাত্র পোশাক হচ্ছে মুজিব কোট। অন্য কোনো পোশাকে তাকে দেখা যায়নি। প্রধানমন্ত্রীর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন পোশাক আমার একটাই। সেটি হলো- মুজিব কোট। জীবনের শেষ পর্যন্ত এই পোশাকই থাকবে।
১১.