আবুল হোসেন (রাজবাড়ী ) থেকে :১৭ মার্চ-২০২০,মঙ্গলবার।
৯০ বছরের বৃদ্ধা ফয়মানা বিবি। পৃথিবীতে স্বামী-সন্তান বলে কিছু নেই। দীর্ঘদিন ভূমিহীন হতদিরদ্র ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রিতা। তিন বেলা ঠিকমত খাবারও জোটে না তার। মৃত্যুর দিন গুনতে গুনতে অনেকটাই হাঁফিয়ে উঠেছেন। এখনো পর্যন্ত তার ভাগ্যে জোটেনি বয়ষ্ক ভাতা অথবা বিধবা ভাতাসহ কোন সরকারী কোন সুযোগ-সুবিধা। ঠিকমত শুনতে না পেলেও ক্ষোভ আর কষ্ট ভরা কণ্ঠে বলেন, ‘বাজানগো মরনও আমাগো চোহে দেখে না ’
বলছিলাম গোয়ালন্দ উপজেলার বিচ্ছিন্ন দ্বীপ পদ্মার চর কুশাহাটা এলাকার ফয়মানা বিবির কথা। সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, শুধু ফয়মানা বিবি নয়, এখানে এরকম শত শত কষ্টের গল্প। কথা হয় আরেক অসহায় বৃদ্ধা তারা বিবি’র সাথে। তাঁর বয়সও ৭৫ ছাড়িয়েছে। কিন্তু পাননি সরকারী কোন সুযোগ সুবিধা। এসময় তারা বিবি’র ভাই জাকির মন্ডল জানান, তার বড় বোন অনেক আগেই বিধবা হয়েছে। সন্তানরাও খোঁজ খবর নেন না। তাই তার বোন তার কাছেই থাকে। তিনি আরো বলেন, নদী ভাঙনের শিকার হয়ে তিনি নিজেই ভূমিহীন হয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। অন্যের জায়গায় ঝুপড়ি ঘর তুলে কোন মতে থাকেন। তার পরও বোনকে তো আর ফেলে দেয়া যায় না। নদীতে মাছ শিকার করে কোন মতে বেঁচে আছেন।
গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ইউনিয়নের পদ্মার বুকে জেগে ওঠা বিশাল এই কুশাহাটা চরে ৬/৭ বছর আগে বসতি শুরু হয়। এক এক করে বর্তমানে সেখানে প্রায় ২শ পরিবার বসবাস করছে। এখানে বসবাসকারীদের নিজস্ব কোন জমি নেই। কুশাহাটা চরে অন্তত ২ হাজার লোকের বসবাস হলেও এদের কারোই হাতে নেই গোয়ালন্দ উপজেলা জাতীয় পরিচয় পত্র। তাদের কাছে রয়েছে মানিকগঞ্জ, পাবনা, রাজবাড়ী সদরসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার জাতীয় পরিচয় পত্র। যে কারণে আইনানুয়ায় তারা সরকারী কোন সুযোগ সুবিধা পাননা।
এখানে নেই হাট-বাজার, রাস্তা-ঘাট, চিকিৎসা কেন্দ্র। এখানকার মানুষের প্রধান পেশা কৃষি ও মৎস্য শিকার। অনেকের বাপ-দাদার জমি নদী ভাঙ্গনের পর জেগে ওঠায় ফের বসতি গড়েছেন কুশাহাটা চরে। কারো পরিবারের কোন সমস্যা, নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে বা জরুরী চিকিৎসার প্রয়োজন পড়লে যাতায়াতের একমাত্র ভরসা নৌকা। সেই নৌকাও শুধুমাত্র দিনের আলোতে চলাচল করে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই নৌকাতে তাদের পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে চলাচল করতে হয়। এলাকায় আচার-অনুষ্ঠানের জন্য বাজার করতে ছুটতে হয় গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী বা পাশের পাবনা, মানিকগঞ্জ জেলা শহরে।
সরেজমিন দেখা যায়, দৌলতদিয়া ফেরিঘাট থেকে ৮/১০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে পদ্মার চরে কুশাহাটা এলাকা। ঝড়-বৃষ্টি ও নদীর সাথে যুদ্ধ করেই চলে এদের জীবন জীবিকা। এখানকার শিশুদের শিক্ষার জন্য নেই কোন সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ব্যাক্তি উদ্যোগে প্রাইভেট পড়ানোর মত করে গড়ে ওঠেছে পায়াকট্ বাংলাদেশ এনজিওর একটি প্রি প্রাইমারী স্কুল। ওই স্কুলের শিক্ষক মো. ওয়াজ উদ্দিন সরদার। তার শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি পাশ। তিনি জানান, দুই বছর আগে একজনের একটি ঘর মাসে ৫শ টাকায় ভাড়া নিয়ে তিনি স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে তার স্কুলে ৭১ জন শিক্ষার্থী আছে। শুধু শিশু শ্রেণি দিয়ে শুরু করলেও আগের বছরের শিশু শ্রেণির শিক্ষার্থীরা প্রথম শ্রেণিতে উঠেছে। তিনি একাই অন্য শিক্ষার্থীদের সহযোগিতায় দু’টি কাসে পড়ান। দোচলা টিনের ঘরে যখন একটি শ্রেণির কাস নেয়া হয় তখন অপর শ্রেণির শিক্ষার্থীরা বাইরে অপেক্ষা করে। শিক্ষার্থীদের দেয়া বেতন থেকেই তিনি বেতন নেন। এসময় তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘স্কুলে ৭১ জন শিক্ষার্থী থাকলেও প্রতি মাসে ১০ জন শিক্ষার্থীও বেতন পরিশোধ করতে পারে না। এখানকার সবাই অত্যন্ত গরীব। তাই তাদেরকে কোনরূপ চাপও দেয়া যায় না।’
কুশাহাটা চরের বাসিন্দা মো. মহিউদ্দিন জানান, এই চরে বসবাস করা সহ¯্রাধিক মানুষ এই দেশের নাগরিক হলেও তাদের নূন্যতম কোন নাগরিক সুবিধা নেই। ইতিমধ্যে তাদের ভোটার তালিকায় নাম উঠলেও হাতে পাননি জাতীয় পরিচয়পত্র। চরের শিশুরা এখানে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহনের সুযোগ পেলে পরবর্তীতে তাদের শিশুদের বাইরে আত্মীয়-স্বজন অথবা অন্য কোথায় রেখে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে পারতেন।
এ প্রসঙ্গে গোয়ালন্দ উপজেলা শিক্ষা অফিসার মো. আব্দুল মালেক জানান, কুশাহাটা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় নামে যে স্কুলটি রয়েছে অন্তত দুই যুগ আগে নদী ভাঙনের শিকার হয়ে দেবগ্রাম ইউনিয়নের পুন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমানে সেখানে পাঁকা ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা স্থাপন করা হয়েছে। যে কারণে ওই স্কুল আর স্থানান্তরের সুযোগ নেই। তবে কোন শিশুর শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করার সুযোগ নেই। কুশাহাটা চরবাসী যদি লিখিত আবেদন করেন, তবে আমি একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবনা পাঠাতে পারব। সেক্ষেত্রে কমপক্ষে দুই হাজার জনগণের জন্য একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের আইন রয়েছে।
গোয়ালন্দ উপজেলা সমাজ সেবা অফিসার চন্দন কুমার মিত্র জানান, কুশাহাটা চরের বাসিন্দাদের কাছে গোয়ালন্দ উপজেলার নাগরিক হিসেবে জাতীয় পরিচয় পত্র নেই। তাই নিয়ম অনুযায়ী এই উপজেলার হত দরিদ্রদের জন্য সরকারী সুযোগ-সুবিধা প্রদানের সুযোগ নেই। বিষয়টি তারা মানবিক দৃষ্টি কোন থেকে দেখলেও আইনী জটিলতায় তাদের কিছু করার থাকে না।
গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাচন অফিসার মো. নিজামউদ্দিন আহমেদ এ প্রসঙ্গে জানান, কুশাহাটা চরের বাসিন্দারা স্থানান্তরিত ভোটার হিসেবে গত নির্বাচনে ভোট প্রদান করেছেন। গোয়ালন্দ উপজেলার বাসিন্দা হিসেবে জাতীয় পরিচয় পত্র পেতে কমিশনের আইন অনুযায়ী নির্ধারিত ফি ব্যাংকে জমা দিয়ে নির্বাচন অফিসে আবেদন করতে হবে। এরপর আইনী প্রক্রিয়া শেষে তাদের জাতীয় পরিচয় পত্র দেয়া যাবে। কুশাহাটার বাসিন্দারা একদিকে দরিদ্র অপরদিকে অশিক্ষিত, তাই এ প্রক্রিয়া তাদের জন্য অনেকটাই কঠিন, এক্ষেত্রে অন্য কোন পন্থা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রচলিত আইনের বাইরে তো কিছু করার নাই’।
গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রুবায়েত হায়াত শিপলু বলেন, কুশাহাটার মত পদ্মাপাড়ে বিচ্ছিন্ন গোয়ালন্দ উপজেলায় আরো দু’টি চর আছে। সেখানে গুচ্ছগ্রাম স্থাপন করা হয়েছে। ওই চরের বাসিন্দারা ইতিমধ্যে সরকারি সুযোগ-সুবিধার আওতায় এসেছে। একই ভাবে কুশাহাটা চরবাসীর জন্য সকল অন্তরায় কাটিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহন করা হবে।
মানিকগঞ্জে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বঙ্গবন্ধুর