শাহজাহান আলী মনন, নীলফামারী জেলা প্রতিনিধি ॥০১ ফেরুয়ারী-২০২০,শনিবার।
এক দাখিল মাদরাসার সুপারের স্বামী ও একই প্রতিষ্ঠানের সহ-সুপার চাকুরী দেওয়ার নামে প্রতারণা করায় টাকা দিয়ে চরম বিপাকে পড়েছে চাকুরী প্রত্যাশী কয়েকজন যুবক। তারা না পাচ্ছে তাদের টাকা, না পাচ্ছে চাকুরী। বরং টাকা ফেরত চাওয়ায় অপমানিত করাসহ প্রাণ নাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে তাদের। এতে বছরের পর বছর পার হওয়ায় চরম দূরাবস্থায় দিনাতিপাত করতে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের। আর সহ-সুপার নতুন নতুন ব্যক্তিদের কাছ থেকে আবারও টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ধান্ধায় মত্ত। এমন ঘটনা ঘটেছে নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার কাশিরাম বেলপুকুর ইউনিয়নে।
চাকুরী প্রত্যাশী ও ভুক্তভোগী যুবক একই ইউনিয়নের মৃত. পদর উদ্দিনের ছেলে আব্দুর রউফ জানান, প্রায় সাড়ে ৩ বছর আগে কুমারগাড়ী দাখিল মাদরাসার সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক ফজলুল হক এর ছেলে ও একই মাদ্রাসার সহ-সুপার আবুল কালাম (আবু) প্রতিষ্ঠানের ক্লার্ক এর শুন্য পদে আমাকে নিয়োগ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়।
এসময় আবু জানায়, ইতিপূর্বে যে এ পদে ছিল সে আর চাকুরী করবেনা। তাই তার টাকা ফেরত দেওয়া লাগবে, একারণে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিতে হবে। সে অনুযায়ী আবু আমাদের বাড়িতে এসে নগদ ১ লাখ ১৩ হাজার টাকা নিয়ে যায়। কিন্তু পরবর্তীতে জানতে পারি যে পদটি শুন্য নয় এবং পাটোয়ারীপাড়ার ডলার নামের একজনের কাছ থেকেও একইভাবে টাকা নেওয়া হয়েছে। মূলতঃ যে ব্যক্তি ওই পদে কর্মরত রয়েছেন তিনি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত না হওয়ায় নিয়মিত ডিউটি করেন না। কিন্তু তাকে বাদও দেওয়ায় হয়নি। কারণ তাকে বাদ দেওয়া হলে তার টাকাও ফেরত দিতে হবে। এমতাবস্থায় আমি আরও জানতে পারি যে ডাঙ্গাপাড়ার অপর যুবক রশিদুলের কাছ থেকেও একই পদে নিয়োগ দেওয়ার নামে আবুল কালাম টাকা নিয়েছে।
এমতাবস্থায় আমি আমার টাকা ফেরত দিতে বলি। সে বলে, টাকা দিবোনা তুমি এসে জয়েন করো। কিন্তু আমার বক্তব্য পদটি শুন্য হিসেবে সুনিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমি ওই চাকুরী করবোনা। এতে আবু টাকা ফেরত দিবেনা বলে সাফ জানিয়ে দেয়।
পরে বিষয়টি মাদরাসার সভাপতি ও আবুর বাবা ফলজুল হক মাস্টারকে জানালে তিনি বলেন, পদটি শুন্য নয়। তোমাকে কিভাবে নিয়োগ দিবে। তখন তিনি এ ব্যাপারে মিমাংসা করার জন্য টাকা ফেরত দিতে সময় নেয়। কিন্তু আজ প্রায় সাড়ে ৩ বছর হতে চললো টাকা ফেরত দিচ্ছেনা আবু। ৬ মাস আগে টাকার ব্যাপারে কথা বলতে মাদরাসায় গেলে আবু চরম অপমান করে এবং আবারও টাকা চাইতে গেলে প্রাণে মেরে ফেলবে বলে হুমকি দেয়।
পরে প্রতিষ্ঠানের সহ-সভাপতি আনসার কমান্ডার সামসুল হকের মধ্যস্থতায় মাত্র ৪০ হাজার টাকা ফেরত দেয় এবং বাকি টাকা দেওয়ার জন্য বিগত ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় নেওয়া হয়। সে সময় পেরিয়ে গেলেও বাকি টাকা ফেরত দেয়নি বরং উল্টো বলছে টাকা দেওয়া হবেনা, কি করার আছে করতে।
আব্দুর রউফ আর বলেন, জমি বিক্রি করে, ধার-দেনা করে অনেক কষ্টে ১ লাখ ১৩ হাজার টাকা দিয়েছি। কিন্তু দীর্ঘ দিনেও চাকুরী তো দূরের কথা প্রদত্ত্ব টাকা না পেয়ে চরম দূরাবস্থার মধ্যে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচিছ। টাকার টাকা গেছে, সাড়ে ৩ বছর সময় গেছে। সে সাথে টাকা তোলার জন্য বিভিন্ন জনের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হয়েছে, অপমানিত হতে হয়েছে। এখন টাকা চাইতে গেলে আদালতে মামলা করে নেওয়ার জন্য বলে। কারণ তার এক ভাই সাদেক মুহুরী নীলফামারী কোর্টে আইনজীবির সহকারী হিসেবে কাজ করে। আরেক ভাই সাব-জজ এর পেশকার হিসেবে কর্মরত। একারণে সে প্রতিনিয়ত চাকুরী দেওয়ার নামে বেকার চাকুরী প্রত্যাশীদের ফাঁদে ফেলে একের পর এক প্রতারণা করে চলেছে। মাদরাসাটা যেন তাদের পৌত্রিক সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। এটাকে পুঁজি করে সভাপতি বাবা আর সহ-সুপার ছেলে মিলে নিয়োগ বানিজ্য চালাচ্ছে। এটাই যেন এখন তাদের আয়ের একমাত্র উৎস।
সে আক্ষেপ করে বলে, এমন একজন মাদরাসা শিক্ষকের কাছ থেকে শিক্ষার্থীরা কি শিক্ষা অর্জন করবে? যার নিজেরই চরিত্র ঠিক না, সব সময় মিথ্যে কথা বলে, প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে চাকুরী দেওয়ার নামে কয়েকজনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে হয়রানী করে। তিনি কি করে জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুশিক্ষিত করবে?
এ ব্যাপারে মাদরাসায় গিয়ে কথা হয় অভিযুক্ত সহ-সুপার আবুল কালামের সাথে। তিনি অভিযোগ শোনা মাত্রই তা অস্বীকার করেন। এবং বলেন, অভিযোগ সত্য হলে অভিযোগকারী আদালতের আশ্রয় নিচ্ছেন না কেন? আমার বিরুদ্ধে মামলা করুক আমি ্আদালতেই এর জবাব দেবো। সাংবাদিকদের যখন অভিযোগ করেছে, তখন আপনারা আমার বিরুদ্ধে যত পারেন লেখেন। আমি দেখে নিবো। আপনারা পত্রিকায় না লিখে কেন এখানে এসেছেন? এসময় তিনি নিজেকে সাংবাদিক ও আইনজীবি হিসেবেও পরিচয় দিয়ে বলেন, বিগত ১৫ বছরে অনেক সাংবাদিক দেখেছি। কেউ কিছুই করতে পারেনি।
এসময় উপস্থিত মাদরাসার সুপার ও আবুল কালাম এর স্ত্রী ফেরদৌসী বেগমের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, মূলতঃ আমি মহিলা মানুষ তাই অফিসিয়াল বিষয়গুলো আমার স্বামীই দেখেন। আমি শুধু মাদরাসা চালাই এবং যেখানে স্বাক্ষর দেওয়ার প্রয়োজন হয় সেখানে স্বাক্ষর দেই।
ক্লার্ক পদে চাকুরী দেওয়ার জন্য আব্দুর রউফ এর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, তার কিছু টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে বাকি টাকা দেওয়া হবে। এসময় আব্দুর রউফ উপস্থিত সকলের সামনেই তার স্ত্রীকে ধমক দিয়ে বলে, আমি বলছি টাকা নেইনি। তুমি কেন টাকা নেওয়ার কথা স্বীকার করলে। এজন্যই তো তোমাকে কথা বলতে দিতে চাইনি। টাকা নেওয়ার কথা প্রমানিত হয়ে যাওয়ায় অবস্থা বেগতিক দেখে আবুল কালাম রাগান্বিত হয়ে নানা হুমকি ধামকি দিতে দিতে মাদরাসা থেকে পালিয়ে যায়।
এসময় উপস্থিত মাদরাসার সহ-সভাপতি আনসার ভিডিপি কমান্ডার সামসুল ইসলামের সাথে কথা হলে তিনি বিষয়টি জানতেন না বলে মন্তব্য করেন। অথচ তিনিই ৬ মাস আগে এ ব্যাপারে মিমাংসা করে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে তাকে চেপে ধরলে তিনিও দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন।